জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের নামের তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। গেজেট প্রকাশের তারিখ বুধবার (১৫ জানুয়ারি) লেখা হলেও এটি প্রকাশ্যে এসেছে বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি)।মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব হরিদাস ঠাকুর স্বাক্ষরিত গেজেটটিতে শহীদদের মেডিকেল কেস আইডি, নাম, বাবার নাম, বর্তমান ঠিকানা, স্থায়ী ঠিকানা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শহীদদের এ তালিকায় নাম উঠে এসেছে বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার হিজলা গ্রামের কলেজ ছাত্র ছাব্বির ইসলাম শাকিবের (২১) নাম।
ছাব্বির ওই গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য মো. শহিদুল্লাহ মল্লিক ও গৃহীনি কাকলী বেগমের একমাত্র ছেলে।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে আজও চোখের পানি ঝরছে সাব্বিরের মা কাকলী বেগমের। ছাবিরের গেজেট নং-১০৫। মেডিকেল কেস আইডি-৯৬৬৩।
শুক্রবার (১৭ জানুয়ারী) দুপুরে ছাব্বির সম্পর্কে তাঁর বড় বড়বোন শারমিন আক্তার বলেন, ‘ছাব্বির চিতলমারী শেরেবাংলা ডিগ্রি কলেজের ছাত্র ছিলো। ছাত্রজীবন থেকেই সে মনে-প্রাণে বিএনপি করত। ছাব্বির ছিল শেরে বাংলা কলেজ ছাত্রদলের সক্রিয় সদস্য। শতবাধা পেরিয়ে সে বিএনপির ডাকা উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের প্রতিটি মিছিল মিটিংয়ে অংশ গ্রহন করত। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পুলিশ বাহিনী ও তার লোকজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতা হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ওই সময় ছাব্বিরের এইচএসসি পরীক্ষা চলছিলো। ১৪ জুলাই পদার্থ বিজ্ঞান পরীক্ষা দিয়ে বিকালে সে বাড়ি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। রাতে আমার (শারমিনের) বাসায় টঙ্গিতে ওঠে। পরদিন অন্দোলনে যোগ দিতে চেষ্টা করলে আমরা তাকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করি। কিন্তু সব চাপ উপেক্ষা করে ১৯ জুলাই (শুক্রবার) সকাল ১০টায় ভাগ্নে-ভাগ্নিদের জন্য পাশের দোকান থেকে মোজো এবং চিপস কিনে আনবার কথা বলে সরাসরি উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালের সামনে চলে যায়। ওখানে গিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাথে দিনভর বিক্ষোভে অংশ নেয়। বিক্ষোভকালীন সময় সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে পুলিশের ৫টি গুলি ছাব্বিরকে ঝাঁঝরা করে। শাহাদাৎ বরণ করে ছাব্বির। সন্ধ্যা ৭ টার দিকে আমার বাবার ফোনে জানতে পারি ভাই ছাব্বির গুলিতে মারা গেছে। পাগলেরমত ছুটেযাই ভাইয়ের খোঁজে। সেখানে গিয়ে দেখি গুলিতে ঝাঁঝরা ভাইয়ের রক্তমাখা নিথর দেহ পড়ে আছে। ডাক্তার বলেন, আপনার ভাই মারা গেছে, দ্রুত লাশ নিয়ে যান।’
শারমীন আরও জানান, তারা যখন গাড়ীতে করে লাশ নিয়ে বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন তখন পথে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের লোকেরা লাশবাহী গাড়ীতে হামলা ও ভাংচুর চালায়। পরিস্থিতি সামাল দিয়ে লাশ অন্য একটা গাড়ীতে উঠিয়ে রাত সাড়ে তিনটায় গ্রামের বাড়িতে আসেন। লাশ আনার পর আমাদের পরিবারসহ গ্রামবাসীকেও এক নজর দেখার সুযোগ দেয়নি শেখ হাসিনার বাহিনী। লাশ দাফনের জন্য মাত্র ৪০ মিনিট সময় বেঁধে দিয়েছিলো। আমরা এ হত্যার বিচার চাই।
গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ ছাব্বিরের মা কাকলী বেগম কান্নাজড়িতকণ্ঠে বলেন, ‘যার সন্তান হারায় নেই, সে সন্তান হারানোর যন্ত্রণা বুঝবেনা। এখনও শুনতে পাই ছাব্বির আমাকে মা’ মা’ বলে ডাকছে। কিন্তু আমার বাবাতো চলে গেছে অনেক দূরে।’
সরকারি এ গেজেট অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে শহীদ হয়েছেন ৮৩৪ জন। প্রত্যেকের নামের পাশে মেডিকেল কেস আইডি অন্তর্ভুক্ত করে তালিকা করা হয়েছে। এদিকে শহীদ ও আহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে শিগগিরই ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অধিদপ্তর’ করতে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ৮৩৪ জন নিহতের পাশাপাশি এ অভ্যুত্থানে আহত হয়েছেন প্রায় ১৫ হাজার ছাত্র-জনতা। মূলত এই গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি রক্ষা করতে এবং আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণ দিতে কাজ করবে নতুন অধিদপ্তর।
খুলনা গেজেট/এএজে